কখনো কি মনে প্রশ্ন জেগেছে সমগ্র ইন্টারনেটের মালিক কে? মনে প্রশ্ন জাগুক বা না জাগুক, আজ প্রশ্নের উত্তর নিয়েই এসেছি আপনাদের মাঝে

চলুন কল্পনার রাজ্য থেকে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি। আস্তে করে চোখ বন্ধ করুন, মনে করুন একটি বিশাল হল ঘরে আপনি বসে আছেন। ঘর ভর্তি বিশ্বের সব দেশের মানুষ, তারা নিজেরা নিজেদের মাতৃভাষায় যে যার মতো কথা বলে চলেছে। ঘরময় একট বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, কেউ কারো কথা বুঝতে পারছে না। এখন আপনি নিশ্চয় টেবিলে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে বলবেন থামুন আপনারা। এভাবে কথা বললে কেউ কি কারো কথা বুঝতে পারবে? তারপর আপনি তাদের সাথে যোগাযোগের জন্য একটা স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারন করে দিলেন এবং কিছু নিয়ম প্রণয়ন করে দিলেন যাতে প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। ইন্টারনেট হলো ঠিক এমন একটা ব্যবস্থা যার যাহায্যে ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন কম্পিউটার পরস্পরের সাথে একটা নিয়ম রক্ষা করে যোগাযোগ করতে পারে। অবশ্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না মানলে এটা কখনোই সম্ভব হবে না।

ইন্টারনেট (Internet)

ইন্টারনেট হলো বিভিন্ন নেটওয়ার্কের একটা সমন্বিত সংযোগ। আগেই বলেছি এই সংযোগগুলো পরিচালিত হয় কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম নীতির মাধ্যমে যাকে বলা হয় Protocols. এই নিয়মগুলোই সমস্ত নেটওয়ার্কের মধ্যে সহজভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। তবে এ সবকিছুই নির্ভর করে বিশাল রাউটার পরিকাঠামো, নেটয়ার্ক এক্সেস পয়েন্ট (Network Access Points (NAP) এবং কম্পিউটার সিস্টেমের উপর।

তারপর নেটওয়ার্ক সিগনাল প্রেরণ করার জন্য প্রয়োজন কৃত্রিম উপগ্রহ (স্যাটেলাইট), হাজার হাজার মাইল বিস্তৃত কেবল এবং সহস্র ওয়্যারলেস রাউটার। এতো কিছুর সমন্বয়ে যে বৈশ্বিক সিস্টেম গঠিত হয়েছে তা কোন কিছুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারেনি, অতিক্রম করে চলেছে দেশের পর দেশ, সাগর মহাসাগর এবং পাহাড় পর্বত। কোন দেশের সীমানা আটকে রাখতে পারেনি এই চলমান প্রযুক্তির আশির্বাদকে। দিনের পর দিনে এটি সংযুক্ত করছে শত নেটওয়ার্ককে। এ যেন মোবাইলে সাপের গেমটার মতো, খাবার খাচ্ছে আর বড় হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি দেশে এখন ইন্টারনেট সংযোগ আছে।বর্তমান বিশ্বের সবাই এখন একটি নিদিষ্ট নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো এই বিশাল নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রন করছে কে? এটার উত্তর জানাতেই টিউনের বাকি অংশে আপনাদের স্বাগতম।

সমগ্র ইন্টারনেটের মালিক কে?

অনেকগুলো ছোট ছোট সিস্টেম মিলে যে দৈত্যাকার ইন্টারনেট তৈরী হলো, তাকে আমরা একটা বিশেষ সত্ত্বা বলতেই পারি। এখন এই একটা সত্ত্বার সত্ত্ব কার হবে? এটা কি একজন নিয়ন্ত্রন করে নাকি অনেকেই বা বিশেষ কোন গোষ্ঠী? আপনার মন কি বলে? এটাকি সত্যিই কোন বিশেষ একজনের দ্বারা নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব? যাহোক, হয়তো অনেকেই প্রশ্ন দেখে দ্বিধান্বিত হয়ে গেছেন, চলুন দুইটা অপশন দেই। দেখি আপনার ধারনার সাথে মিলে কিনা।

সমগ্র ইন্টারনেটের মালিক-
  • ক. কেউ না
  • খ. অনেক মানুষ
যদি আপনি মনে করেন ইন্টারনেট হলো একটি সম্মিলিত কিন্তু একক সত্ত্বা এবং কারও এটার উপর মালিকানা নেই। তাহলে নিশ্চয় এর জন্য কোন নির্দিষ্ট সংগঠন থাকবে যা এর গঠন এবং কাজ নিয়ন্ত্রন করে কিন্তু এই সমগ্র ব্যবস্থার উপর তাদের কোন মালিকানা নেই। কোন দেশের সরকার এর উপর মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনা। অথবা ভাবতে পারেন হাজার হাজার মানুষ এটার মালিক। ইন্টারনেটকে যদি অনেকগুলো পার্টের সমষ্টি হিসাবে কল্পনা করেন তাহলে অনেক মানুষ একেকটি পার্টের মালিক যারা এর উন্নয়নে কাজ করছে। আপনার ভাবনাগুলো যাইহোক, আপনি ধারেকাছে গেলেও আসল ঘটনার সাথে সামান্য পার্থক্য আছে। চলুন জেনে নেই কি সেই পার্থক্য।

ইন্টারনেটের সত্যিকারের মালিক

যে ফিজিক্যাল নেটওয়ার্ক বিভিন্ন কম্পিউটারের মধ্যে ইন্টারনেট ট্রাফিক পরিবহন করে তাকে বলা হয় ইন্টারনেটের মেরুদণ্ড (Internet Backbone). আগেকার দিনের ইন্টারনেট সিস্টেমে ARPANET ইন্টারনেটের মেরুদন্ড বা Backbone হিসাবে কাজ করেছে। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানি যারা রাউটার এবং ক্যাবলের যোগানের মাধ্যমে ইন্টারনেট মেরুদন্ড হিসাবে কাজ করছে। এই কোম্পানি গুলোকেই বলা হয় ইন্টারনেট সেবা দাতা বা আইএসপি (Internet Service Provider)। এখন কোন দেশ বা যদি কেউ নিজের প্রয়োজনে ইন্টারনেট এক্সেস পেতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই এই আইএসপির সাথে যোগাযোগ করতে হবে। বিশ্বের সে সকল আইএসপি বা ইন্টারনেট সেবা দাতা প্রতিষ্ঠান বিখ্যাত তারা হলেন- UUNET, Level 3, Verizon, AT&T, Qwest, Sprint, Sprint, IBM ইত্যাদি।

বড় বড় আইএসপি গুলো থেকে আবার ছোট ছোট আইএসপি সৃষ্টি হয়েছে। যারা আমাদেরকে সেবা দিয়ে থাকে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, যে সিস্টেম আমাদের কম্পিউটার টু কম্পিউটার ডাটা এক্সচেঞ্জ করে থাকে তাকে বলা হয় Internet Exchange Points (IXP)। বিভিন্ন কোম্পানি এবং অলাভজনক কিছু প্রতিষ্ঠান এটা নিয়ন্ত্রন করে থাকে। এখন কথা হলো প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা আইএসপির আলাদা ইন্টারনেট থাকে। এখন আপনি একক ভাবে যদি কোন কম্পিউটার দিয়ে সেই ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হতে হোন তাহলে সেই ইন্টারনেটের মালিক আপনিও। মানে হলো, আপনি নিজেও ইন্টারনেটের একটা অংশের মালিক। কারন সমগ্র ইন্টারনেটের কোন মালিকানা হয় না। যদিও অনেক প্রতিষ্ঠান বা দেশের সরকার নিজেদের ইন্টারনেট ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে যাকে বলা হয় লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক বা LAN (Local Area Network)। যাহোক, মুদ্দা কথা হলো আপনি এবং আমি আমরা সকলেই একেক জন একেকটা ইন্টারনেট খণ্ডের মালিক। নিজেকে তো মালিক বলে দাবী করে ফেলেছেন, এখন কি মনে প্রশ্ন আসছে না যে এই জিনিসের দায়িত্ব আপনি কতোটা নিয়েছেন? আপনি যদি এর দায়িত্ব না নিয়ে থাকেন তাহলে এই সব কিছুর জন্য কে দায়িত্ব নিবে?

সবকিছুর জন্য তাহলে দায়ী কে?

মানুষের স্বভাব হলো উপরে উপরে অনেক কথা বললেও কাজের বেলায় দায়িত্ব নিতে পারে না। যেভাবে আপনাকে ইন্টারনেটের মালিক বানিয়ে খুশি করে দিলাম সেভাবে যদি আপনার উপর ইন্টারনেটের দায়িত্ব দিয়ে দিই তাহলে আপনার দায়িত্ব নেওয়া তো দুরের কথা আমার দফা রফা করে দিবেন। যাহোক, আমি আগেই বলেছিলাম যে ইন্টারনেট ব্যবস্থাটা চলে কিছু নিয়মের উপর যাকে আমরা প্রটোকলস (Protocols) বলি। সেই প্রটোকলগুলো মেনেই একটি কম্পিউটার ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের সাহায্যে অন্য কম্পিউটার তথ্য প্রদান করে। প্রটোকল না মেনে কোন কম্পিউটার তথ্য প্রদান করতে পারেনা। এখন যদি কোন প্রটোকল না থাকে তাহলে আপনাকে আগে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে আপনি অন্য কম্পিউটারে যে তথ্য প্রদান করছেন তার জন্য আপনাদের বোঝাপড়া আছে। এবং আপনার পাঠানো তথ্য সঠিক গন্তব্যেই পৌছাতে পারবে।

এখন কথা হলো ইন্টারনেটের যে হারে উন্নয়ন হচ্ছে তাতে বিংশ শতাব্দীর প্রটোকলের সাথে একবিংশ শতাব্দীর প্রটোকল বা আগের বছরের সাথে পরের বছরের প্রটোকল একই রকম থাকবে এটা ভাবা বোকামী। ইন্টারনেটের উন্নতির সাথে এই প্রটোকল গুলোরও উন্নতি প্রয়োজন। তার মানে দাড়ালো, কাউকে না কাউকে এই নিয়মগুলো মানে প্রটোকল পরিবর্তন করতে হবে। আপনাদের আর প্রশ্ন করবো না, সমগ্র ইন্টারনেট কাঠামো এবং প্রটোকল ঠিক করে দেওয়ার জন্য রয়েছে অনেকগুলো সংগঠন যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। চলুন তাদের সম্পর্কে কিছু জেনে নিই।
  • The Internet Society: একটি অলাভজনক সংগঠন যারা ইন্টারনেট স্ট্যান্ডার্ড এবং পলিসি নির্ধারন এবং উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
  • The Internet Engineering Task Force (IETF): এটি একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন যাদের রয়েছে ওপেন মেম্বারশীপ পলিসি এবং এরা বিভিন্ন গ্রুপ ভিত্তিক কাজ করে থাকে। ইন্টারনেটের বিভিন্ন বিষয়কে এরা আলাদা আলাদা ভাগ করে প্রত্যেক ভাগের জন্য দক্ষ জনশক্তিকে কাজে লাগায় এ সংগঠনটি। বর্তমান ইন্টারনেটের এই স্থিতিশীলতা এই সংগঠনের অনবদ্য অবদান।
  • The Internet Architecture Board (IAB): এরা সাধারনত ইন্টারনেট প্রটোকল প্রণয়ন এবং স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারনে কাজ করে থাকে।
  • The Internet Corporation for Assigned Names and Numbers (ICANN): এই সংগঠনটি ব্যক্তিগত কিন্তু অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান যাদের কাজ হলো এটা নিশ্চিত করা যে প্রত্যেকটা ডোমেইন নেইম সিস্টেমের (Domain Name System (DNS) সাথে সঠিক আইপি এড্রেসটি লিংক করা আছে কি না।
এই সংগঠনগুলো ইন্টারনেটের জন্য সবকিছু করলেও এরা কখনো ইন্টারনেটের মালিকানা দাবি করতে পারেনা। আসল কথা হলো কেন্দ্রিয়ভাবে ইন্টারনেটের কোন মালিকানা নেই। অনেকেই এটার উন্নয়নে কাজ করলেও এখনো পর্যন্ত কেউ এটার মালিকানা দাবি করতে পারেনি।

শেষ কথা

আমরা টিউনটির একেবারে শেষ প্রান্তে এসে গেছি। জানিনা টিউনটি আপনাদের কতোটা ভালো লেগেছে। তথ্যগুলো একটার সাথে আরেকটার সন্নিবেশ ঘটানো খুব কঠিন কাজ ছিলো, আমি আমার সর্বোচ্চটুকু চেষ্টা করেছি আপনাদেরকে সঠিক জ্ঞানটুকু দেওয়ার জন্য। আপনাদের উপলব্ধি আপনাদের টিউমেন্ট থেকে আমি বুঝতে পারবো। টিউনটি ভালো লাগুক বা মন্দ লাগুক আপনি নির্দ্বিধায় টিউমেন্ট করে জানান। আপনার একটি সুচিন্তিত মতামত আমাকে আরো ভালো টিউন করতে এবং ভুলগুলো শোধরাতে সাহায্য করবে। সবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা বাংলা ভাষার টেকনোলজি ভান্ডারকে আরও সমৃদ্ধ করবে। তবে টেকটিউনস পরিবারের সকলের প্রতি অনুরোধ, চলুন আমরা কাউকে অনুকরণ না করে অনুসরণ করতে শিখি। কপি পেস্ট না করে নিজের মতো করে উপস্থাপনের চেষ্টা করি। টেকটিউনস পরিবারকে সমৃদ্ধ করতে আপনার আমার সকলের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। যাহোক, আজ এখানেই শেষ করছি দেখা হবে আগামী টিউনে। সে পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং নিরাপদে থাকুন।

কৃতজ্ঞতায়ঃ  সানিম মাহবীর ফাহাদ

Comments